লাইসোজোম ( Lysosome) 



জীবকোষের সাইটোপ্লাজমে অবস্থিত সূক্ষ্ম আবরণীবেষ্টিত, কোষীয় খাদ্য পরিপাককারী ক্ষুদ্র অঙ্গাণুকে লাইসোজোম বলে) বলে।) ইলেকট্রন অণুবীক্ষণ যন্ত্রে দৃষ্ট এই অঙ্গাণুকে প্রথমে পেরিক্যানালিকিউলার ডেন্স বডিজ' (Pericanalicular Dense Bodies) নাম দেওয়া হয়েছিল (লাই (লাইমোজোমকে প্রকৃতপক্ষে কোষের পাচন অঙ্গ বা digestive body বলা হয় যার প্রধান কাজ পরিপাকে সহায়তা করা

আবিষ্কার : ১৯৫২ ১৯৫২ সালে দ্য দুবে (C. de. Duve) ও ওয়াকার সর্বপ্রথম প্লীহাকোষ থেকে এক প্রকার ক্ষুদ্রাঙ্গ অপসারিত করেন, যা থেকে পৃথক করা হয় বহুবিধ বিগলনকারী (Hydrolyting) এনজাইম। এদের নাম হাইড্রোলেজেস (hydrolases)। ১৯৫৫ সালে দ্য দুবে এ ক্ষুদ্রাঙ্গের নামকরণ করেন লাইসোজোম। প্রতিটি লাইসোজোম মূলত বহু বিগলনকারী এনজাইমের এক একটি প্যাকেট।)

অবস্থান: স্তন্যপায়ীর লোহিত কণিকা ছাড়া বাকী সকল প্রকার প্রাণীকোষেই লাইসোজোম থাকে। তবে যে সকল কোষ পরিপাকযন্ত্রের মতো কাজ করে যেমন শ্বেতরক্তকণিকা অথবা ক্ষরণে অংশগ্রহণ করে যেমন- যকৃৎ, অগ্ন্যাশয় ইত্যাদি কোষ, তাদের মধ্যে লাইসোজোম প্রচুর পরিমাণে থাকে। পিট ও গ্যালপিন (১৯৭৩) প্রাণীকোষের লাইসোজোম সম্পর্কে নানাবিধ তথ্য আবিষ্কার করেন। Gahan (১৯৭২-৭৩) কোষ রঞ্জনী (histochemistry) প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন কার উদ্ভিদ কোষের মধ্যে বহু ধরনের লাইসোজোম দেখেন।


আকার আকৃতি: সাধারণত লাইসোজোম গোলাকার বা বর্তুলাকার (Spherical) কিন্তু উদ্ভিদের মেরিস্টেমেটিক কোষে আকৃতিবিহীন বা অনিয়তাকার হয়ে থাকে। লাইসোজোম সাধারণত ০.২-০.৮ মাইক্রন ব্যাসবিশিষ্ট হয়ে থাকে। তবে স্তন্যপায়ীর বৃক্ক কোষের লাইসোজোম ৫ মাইক্রন পর্যন্ত হয়ে থাকে।


গঠন: লাইসোজোমগুলো ঘন দানাদার বস্তু এবং এসিড ফসফেটেজ এনজাইম দ্বারা পরিপূর্ণ গোলাকার গহ্বরবিশিষ্ট হয়ে থাকে। লাইপোপ্রোটিন নির্মিত ঝিল্লি দ্বারা লাইসোজোম আবৃত থাকে। ঝিল্লির প্রধান কাজ হচ্ছে অভ্যন্তরস্থ বিগলনকারী এনজাইমের আক্রমণ থেকে ক্ষুদ্রাঙ্গসমূহকে রক্ষা করা। ঝিল্লির ভেতরের ম্যাট্রিক্সের গঠনের তারতম্য দেখা যায়। কোনটির ম্যাট্রিক্স ঘন, কোনটির চারপাশ ঘন ও মাঝখানটা তুলনামূলকভাবে কম ঘন আবার কতকগুলোর ভেতরে ভ্যাকুওল দেখা যায়।

রাসায়নিক গঠন : এ পর্যন্ত লাইসোজোমে প্রায় চল্লিশ প্রকার এনজাইম তথা হাইড্রোলেজ আবিষ্কৃত হয়েছে। ইলেকট্রন অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নীচে এসিড ফসফেটেজকে মার্কার হিসেবেও গণ্য করা হয়। লাইসোজোমের ঝিল্লিটি অক্ষত অবস্থায় থাকলে উৎসেচকগুলো নিষ্ক্রিয় অবস্থায় থাকে কিন্তু ঝিল্লিটি বিচ্ছিন্ন বা ভেঙে গেলে সক্রিয় অবস্থায় উৎসেচকগুলো বাহির হয়। লাইসোজোমে রাইবোনিউক্লীয়েজ, ডিঅক্সি রাইবোনিউক্লীয়েজ, ফসফেটেজ, গ্লাইকোসাইডেজ, সালফেটেজ, ক্যাথেপসিনস প্রভৃতি নানা রকমের এনজাইম থাকে। লাইসোজোমে বিভিন্ন প্রকার অর্দ্রেবিশ্লেষণকারী এনজাইম থাকে। যেমন- গ্লাইকোসাইডেজ এবং এসিড ফসফেটেজ ইত্যাদি এসকল এনজাইম লাইপোপ্রোটিনের একক পর্দা দ্বারা আবৃত থাকে এবং প্রোজেস্টেরন, টেস্টোস্টেরন, এন্ডোর্টক্সিন, ভিটামিন-এ, ভিটামিন-ই, এক্সরে ও অতিবেগুনি রশ্মির বিকিরণ, পিত্ত লবণ ইত্যাদির প্রভাবে এই পর্দা সহজেই ভেঙে যেতে পারে। কিন্তু সাধারণত লাইসোজোম কোষের মধ্যে স্থির বা অক্ষত অবস্থায় থাকে। কিন্তু কিছু রাসায়নিক পদার্থ লাইসোজোমের এই স্থায়িত্বে সাহায্য করে। যেমন- কোলেস্টেরল, কর্টিনোন, কর্টিসোল এবং ক্লোরোকুইন।


প্রকারভেদ: বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কোষে অথবা কখনো কখনো একই কোষে লাইসোজোমের চারটি রূপ বা আকার দেখা বায়। এগুলো হচ্ছে-

১. প্রাথমিক লাইসোজোম (Primary Lysosome)

২. দ্বিতীয় বা গৌণ লাইসোজোম (Secondary Lysosome)

৩. অবশেষীয় লাইসোজোম (Residual bodies) এবং


৪. স্ব-গ্রাস ভ্যাকুওল বা সাইটোলাইসোজোম বা অটোফ্যাগোসোম (Autophagic vacuoles or cyto lysosomes or Autopagosomes.)


 প্রাথমিক লাইসোজোম : নবগঠিত লাইসোজোমগুলোকে প্রাথমিক। বা প্রাইমারি লাইসোজোম বলে। এগুলো সাধারণত গলজিবডির ভেসিকল হতে উৎপন্ন হয়। অপর কিছু কোষে এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলাম এর বিশেষ অংশ হতেও লাইসোজোম উৎপন্ন হয়ে থাকে।

 দ্বিতীয়ক বা গৌণ লাইসোজোম : এই লাইসোজোমগুলোকে হেটারোফ্যাগোসোম বা পাচক গহ্বরও বলা হয়। যখন কোষ ফ্যাগোসাইটোসিস অথবা পিনোসাইটোসিস প্রক্রিয়ায় কোনো বহিরাগত বস্তু নিজের মধ্যে প্রবেশ করে তখন তা ঝিল্লি দ্বারা আবৃত হয়ে একটি ভেসিকল সদৃশ গঠন তৈরি করে যাকে পিনোসোম বা ফ্যাগোসোম (Pinosome or phagosome) বলে। এই পিনোসোম বা ফ্যাগোসোমগুলো প্রাথমিক লাইসোজোমের সাথে মিলিত হয়ে যায় এবং সেকেন্ডারি লাইসোজোম গঠন করে।

 অবযদিও কোষের অভ্যন্তরে লাইসোজোমের প্রধান কাজ পরিপাক তথাপি কিছু কিছু বস্তু কোষের মধ্যে অপাচ্য থেকে যায়। এই বস্তুগুলো কোষে সেকেন্ডারি লাইসোজোমের মধ্যে থেকে যায়। এই ধরনের পদ্ধতি এককোষী প্রাণীতে বেশি দেখা যায় কিন্তু উচ্চ শ্রেণির প্রাণীতে বিশেষ দেখা যায় না। এই অপাচ্য বস্তুযুক্ত অঙ্গাণুকে অবশেষীয় লাইসোজোম বা রেসিডিউয়াল বডিস (Residual bodies) বলে। অনেক ক্ষেত্রে কোষে রেডুয়াল বডিস এর সংখ্যার উপস্থিতির উপর ভিত্তি করে সে প্রাণীর বয়স নির্ণয় করা হয় কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্নায়ু কোষ এবং পেশী কোষে এই ধরনের লাইসোজোমের সংখ্যাধি লক্ষ্য করা যায় যাদের লিপোফিউসিন গ্রানিউল (Lipofuscin granules) বলে।

Leave a Comment